রবিবার, ৮ মার্চ, ২০০৯

সুস্থ সমাজ গড়তে হবে নিজেদেরকেই

স্বাধীনতার প্রায় আটত্রিশ বৎসর পরে সমস্ত দেশে আবার নতুন করে স্বাধীন স্বাধীন একটা আমেজ এসেছে। সবার মনে নতুন আশা--নতুন উদ্দীপনা।আমরা আশা করছি এবার আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সব কিছু আমাদের আশানুরূপ বদলে যাবে।সমস্ত অনাচার -অত্যাচার-দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হবে।দ্রব্যমূল্য কমবে--মানুষের অভাব-অনটন দূর হয়ে যাবে ।এই প্রত্যাশার পেছনে সব থেকে বেশী সক্রিয় যে ফ্যাক্টর কাজ করছে তা হলো মানুষের আবেগ।আমরা আবেগপ্রবন জাতি।বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই
যুক্তির চেয়ে আবেগই আমাদের পরিচালিত করে বেশী।প্রকৃতপক্ষে এটাই আমাদের সব থেকে বড় শক্তি আবার সব থেকে বড় দুর্বলতাও।সোজা কথায়--আমাদের আবেগ যখন যুক্তির সাথে মিলে কাজ করে তখন আমরা যে কোন কঠিন সমস্যার সমাধান অনায়াসে করে নিতে পারি।আবার এর ব্যত্যয় হলে নেতিবাচক ফলাফলই স্বাভাবিক। নতুন সরকার নির্বাচনে আমাদের যুক্তি এবং আবেগ উভয়ই কাজ করেছে---সব দ্বিধা--সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে আমরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে
অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছি।এটা আমাদের অনেক বড় অর্জন, অনেক বড় সাফল্য।এই সাফল্যের হাত ধরেই আমাদের অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধানও করে নিতে পারবো বলেই বিশ্বাস করি।তবে অতি আবেগীয় প্রত্যাশায় ভেসে না গিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে--রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব না।আমাদের ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে-----একটার পর একটা সমস্যার ক্রমান্বয় সমাধানের।আর আমাদের সব থেকে বড় দুর্বলতা যা তা হলো আমাদের সমস্ত উদ্দীপনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি স্তিমিত হয়ে পড়ে ।এজন্যই আমাদের সাফল্যগুলোকে আমরা শেষপর্যন্ত ধরে রাখতে পারিনা।এই দুর্বলতাটা আমাদের কাটিয়ে উঠতেই হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে--সব সমস্যা সমাধানের চাবি আমাদেরই হাতে।আমরা নিজেরা সচেতন থাকলে--ঝিমিয়ে না পড়লে--কোন অপশক্তিই আমাদের সাফল্যকে দমিয়ে রাখতে পারবেনা।আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস --মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান।এত বড় যুদ্ধগুলো আমরা জয় করে নিতে পেরেছি যখন তখন দেশগড়ার এই যুদ্ধেও আমরা অবশ্যই জয়ী হবো।কিন্তু এজন্য আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে----সচেতন থাকতে হবে।যে কোন অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে সবাইকে এক সাথে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে হবে।দেশগড়া শুধু সরকারের কাজ নয়।আমাদেরও নাগরিক-দায়িত্ব রয়েছে এব্যাপারে।আমাদের চোখের সামনে চোর চুরি করে নিয়ে গেলে আমরা চোর ধরা শুধু পুলিশের দায়িত্ব মনে করে--চুপ করে থাকলে চলবে কেন?এদেশ আমাদের । এর প্রতিটি কণায় মিশে আছে আমাদের শহীদ ভাইদের রক্ত।কাজেই একে সুরক্ষার দায়িত্বে আমাদেরও অনেক বেশী প্রয়োজনীয় ভূমিকা আছে।দারিদ্র্যপীড়িত এদেশের বেশীর ভাগ মানুষই উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে অসচেতন। ভাল-মন্দ বোঝার, নীতি-যুক্তি, ন্যায়-অন্যায় বিচার করার সামর্থ্য তাদের নেই।এদেরকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে সুস্থ -চিন্তার শিক্ষিত বিবেকবান মানুষকেই। 'নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবো কেন'-এ ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকলে যে তিমিরে আছি সেই তিমিরেই পড়ে থাকতে হবে।ঝুড়িতে একটি পচা আম থাকলে বাকী আমগুলোতেও পচন ধরে। কাজেই সুস্থ-সুন্দর সমাজের প্রত্যাশায় শুধু নয়--সুস্থ-সুন্দর সমাজ গড়ার অঙ্গীকারে--- সক্রিয়তায় থাকতে হবে আমাদের নিজেদেরকেই।

আসুন সবাই মিলে আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করি



স্বাধীনতা পরবর্তী সমস্ত নির্বাচনের রেকর্ড ভঙ্গ করে একচেটিয়া জয়লাভ করেছে বর্তমান নির্বাচিত সরকার।এই নির্বাচিত সরকারের কাছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের প্রধানতম দাবী---যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এব্যাপারে সরকারের আগ্রহী সদিচ্ছা আমাদের আশাবাদী হতে সাহায্য করেছে বৈকি।কিন্তু সরকারের উপর সব ভার ছেড়ে দিয়ে আশাবাদী অপেক্ষায় বসে থাকলে আমাদের চলবেনা।এ ব্যপারে সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে হবে আমাদের।একাত্তরের প্রতিটি বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহীর বিচার যাতে সুনিশ্চিত হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে আমাদের সবাইকে--যাতে একটাও যুদ্ধাপরাধী কোন ফাঁক গলে বেরিয়ে না যেতে পারে বিচারের আওতা থেকে।নিষিদ্ধ করতে হবে ওদের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড যাতে আবার সংগঠিত হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।
গ্ণতান্ত্রিক সরকার জনগণের জন্য --জনগণের দ্বারা--জনগনের মধ্য থেকে নির্বাচিত সরকার। কাজেই গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিটি কর্মকান্ডে জনতার সমর্থন এবং অংশগ্রহণ অপরিহার্য।এটা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।আর এই অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে আমাদেরই।নির্বাচনের পরেই নির্বাচিতরা যাতে আমাদের ভুলে না যান--সেটা আমাদেরই দেখতে হবে।এ যাবত কাল আমরা দেখে এসেছি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কিভাবে --কত তাড়াতাড়ি জনগণের কথা ভুলে গেছেন।গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরশাসনের পরাকাষ্ঠা এদেশের মানুষ কম দেখেনি।বিগত তথাকথিত নির্বাচিত সরকারের আমলের স্বৈরাচারী কর্মকান্ড-উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ ----দুই দুইটা বৎসরের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের কথা আশাকরি সবার মনে এখনো তরতাজা।বর্তমান সরকারের কাছে আমরা এমনটি প্রত্যাশা করিনা--তাদের প্রতি আমাদের আস্থারও অভাব নাই।তারপরেও আর যাতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় তা দেখতে হবে--সতর্ক থাকতে হবে---নিশ্চিত করতে হবে এদেশের জনগণকেই।সরকারের প্রতিটি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সহযোগিতা করা যেমন আমাদের কর্তব্য--তেমনি সরকার তথা কোন জনপ্রতিনিধির অন্যায় কর্মতৎপরতায় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়াও আমাদের নাগরিক দায়িত্ব।জনপ্রতিনিধিরা জনগণের মাঝখান থেকেই ঊঠে এসেছেন---ভিন্ন কোন গ্রহ থেকে নয়।আমরা সবাই যেমন ভালমন্দে মেশানো মানুষ--ওরাও তাই।আমাদের প্রায় সকলের মাঝেই কমবেশী অপরাধ-প্রবণতা,লোভ-লালসা আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য এদেশের আপামর জনতা যেভাবে একই প্লাটফরমে জড়ো হয়েছে ---মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে এভাবে একতাবদ্ধ থাকলে এদেশে গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব কিছু নয়।
রাষ্ট্রের কাছে আমরা কি চাই?চাই সুন্দর-নিরাপদ সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা।সন্ত্রাসবিহীন,অন্যায়-অবিচারের বাইরের নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা।আইনের যথাযথ প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ।কিন্তু এসব চাহিদা পূরণে আমাদের নিজেদের দায়িত্ব এবং ভূমিকা কতটুকু ---তা কি আমরা ভেবে দেখি?উন্নত বিশ্বের আইন-কানুনের উদাহরণ বা উপমা আমাদের মতো দারিদ্রপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য খানিকটা হাস্যকরও বটে।যে দেশের অধিকাংশ মানুষ অক্ষরজ্ঞানহীন তারা আইন-কানুন ,রীতি-নীতি জানবে এবং মানবে এটা মনে হয় অতিকল্পনা হয়ে যায়।কিন্তু আমরা যারা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ--আমাদের মাঝে কতজন শতভাগ আইন মেনে চলি?আমরা আইন-কানুনের চর্চা করলে এবং শিক্ষাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এব্যাপারে সচেতন করে তুললে ওরাও আইন মেনে চলতো বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।ওরা চুরি-ছিনতাইয়ের মতো বেআইনী কাজগুলো করে সীমাহীন অভাবের তাড়নায়,অন্যায় করে অজ্ঞতার জন্য।
এসব নিম্নবিত্তরা চুরি করে অভাবে আর উচ্চবিত্তরা চুরি করে ,
অন্যায় জেনেও --লোভের স্বভাবে।
সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নটি আসলেই আইনপ্রয়োগের প্রশ্নটি আসে।আমাদের দেশও আইনের বাইরে নয়--দেশে আইন-কানুন আছে ঠিকই কিন্তু তা মেনে চলার অভ্যাস তৈরি হয়নি আমাদের।শুধু আইন থাকলেই হয়না ---নিজেদের নীতিবোধ এবং বিবেককে জাগ্রত না রাখতে পারলে আইন শুধু কাগজের পৃষ্টায়ই লিপিবদ্ধ থাকবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব আইনের সুষ্ঠূ প্রয়োগ--আইনভঙ্গকারীর দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি বিধান যাতে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার কেউ করার সাহস না পায়।এই শাস্তিবিধান প্রক্রিয়ায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সক্রিয় সহযোগিতা করা আমাদের নাগরিক দায়িত্বের মাঝেই পড়ে।সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুললে অন্যায়কারী কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবেনা।

আসুন আমরা সকলে মিলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই---দৃঢ় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি যাতে সমস্ত দুর্নীতি-সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের আবর্জনা মুক্ত করে একটি সত্যিকারের নিরাপদ --সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।


ভাষা আন্দোলনের শপথ হোক দল মত নির্বিশেষে দেশকে ভালবাসা




অন্যের সাথে ভাববিনিময়ের জন্যই শুধু নয় --ভাষা আমরা ব্যবহার করি নিজের সাথে কথোপকথনের জন্যেও।আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো কখনো নির্বাক নয়।সেই চিন্তা-ভাবনাগুলো অন্যেরা শুনতে না পেলেও আমরা আমাদের নিজের ভেতরে কথাগুলোকে সাজাই-গুছাই--সিদ্ধান্ত নেই।অর্থাৎ একটা মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী তার ভাষা।চিন্তাশুন্য মানুষ যেমন কল্পনা করা যায়না তেমনি ভাষাহীন মানুষও নয়।বোবারও নিজস্ব ভাষা আছে।চিন্তার বাহনই হলো ভাষা।আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো কখনো আমরা নিজের ভেতরেই রেখে দেই, কখনো শেয়ার করি অন্যের সাথে,কখনোবা লিখে রাখি কাগজে- কলমে।ভাষা আমাদের মনও মননের প্রতিনিধি।আবেগ-অনুভবের বাহক।একজন মানুষকে চিনতে হলে ,বুঝতে হলে,তার সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে হলে সাহায্য নিতে হয় ভাষার।স্থান ভেদে কাল ভেদে ভাষা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়।অর্থাৎ ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল।যুগে যুগে ,স্থানান্তরে মানুষের মুখের ভাষা বিবর্তিত হয়---বদলে যায়।আমার নিজের ভাষা আমার নিজের ভৌগলিক অবস্থানের ---জন্মভূমির প্রতিনিধিত্ব করে।আমি বাংলায় কথা বলি,আমার কথ্য ভাষা বাংলা অর্থাৎ আমি একজন বাংগালী।
একজন ইংরেজ ইংরেজীতে কথা বলে।একজন আরব আরবীতে। আবার ব্যতিক্রমও আছে।মনে করি --বাঙ্গালী মা-বাবার সন্তান কিন্তু লালিত -পালিত হলো একটি ভিন্নভাষী পরিবারে ।তার ভাষা কিন্তু বাংলা হবেনা।তার ভাষাও হবে ওই ভিন্নভাষা---যেখানে সে বড় হয়েছে।অন্য কথায় যার যার আজন্ম লালিত পরিবেশেই গড়ে উঠে মানুষের নিজের ভাষা।
একজন মানুষের নিজের ভাষা তার স্বকীয়তা-মৌলিকত্বের নির্দেশক।মানুষ নিজেকে যেমন ভালবাসে ---নিজস্ব স্বকীয়তা,নিজস্ব পরিচিতি, নিজস্ব স্বাধীনতাকে তেমনি ভালবাসে।এতে কোনরূপ বাধা বা প্রতিবন্ধকতা কাম্য নয় কখনোই।এর ব্যত্যয় হলেই সৃষ্টি হয় অসন্তোষের ---যার ফলশ্রুতি বিদ্রোহে রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনা।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের স্বাধীনচেতনার,আমাদের মৌলিকত্বের প্রতি গভীর অনুরাগের প্রতীকি ইতিহাস হয়ে আছে।এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য,প্রেরণা বা তাৎপর্য নিছক বাংলাভাষায় কথা বলা অথবা লিখতে পারার জন্যেই ছিলনা।এর মূল উদ্দেশ্য বা প্রেরণা আরো অনেক গভীরে প্রোথিত।পৃথিবীর মানুষ আজ আর শুধু নিজের ঘরের ভিতর আবদ্ধ নেই।মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী জুড়ে।এ দেশের মানুষ যেমন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে--তেমনি আমাদের দেশেও ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষের অভাব নেই। বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় আমরা কথা বলিনা বা বলবোনা একথাটি ঠিক নয়।পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাকেও গ্রহণ না করলে জ্ঞান-বিজ্ঞান বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে সেটাও আমাদের কাম্য হতে পারেনা।আগেই বলেছি ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র বাংলাভাষায় কথা বলার আন্দোলন ছিলনা---এটা ছিল আমাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতির লড়াই।আমাদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র সত্ত্বার অধিকার প্রতিষ্ঠার ,মর্যাদা রক্ষার লড়াই।নিপীড়ন -নির্যাতন-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে ,অবহেলা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে,কারো ক্রীড়নক হয়ে থাকার বিরুদ্ধে ---যে জাতিসত্ত্বাটি গুমরে গুমরে মরছিল,তিল তিল করে যে ক্ষোভগুলো জমা হয়ে ভিতরে ভিতরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জন্ম দিচ্ছিল --তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে বাহান্নতে।সেই আন্দোলন ছিল আমাদের জাগরণের আন্দোলন। আত্মোপলব্দির আন্দোলন--যার হাত ধরে আজ আমরা একটা স্বাধীন পতাকার অধিকার অর্জন করেছি।পৃথিবীর মাণচিত্রে 'বাংলাদেশ' নামের একটি স্বাধীন ভূখন্ডের নাম লিখেছি।
কোন আন্দোলনের রাস্তাই ফুল বিছানো থাকেনা।যে কোন আন্দোলনের সাফল্য--অনেক ত্যাগ, ধৈর্য , অধ্যবসায় এমনকি অনেক রক্তপাতও দাবী করে।উদাহরণস্বরূপ '১লা মে' শ্রমিক দিবসের কথাই ধরি।১৮৮৬খ্রীষ্টাব্দে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য শিকাগোর রাজপথ রক্ত-রঞ্জিত করে শ্রমিকেরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল,নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিল।তাদের ত্যাগের সুফল আজ আন্তর্জাতিক ভাবে সমস্ত বিশ্বের শ্রমিকেরা ভোগ করছে।সমগ্র বিশ্ব প্রতি বৎসর '১লা মে 'সেসব আত্মোৎসর্গকারী শ্রমিকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।তেমনি করেই আমাদের যে সোনার ছেলেরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে আমাদের ভাষা তথা মৌলিকত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল ---বিশ্ববাসী তাদের সেই আত্মত্যাগকে পরম শ্রদ্ধায় স্বীকৃতি দিয়েছে।আমাদের '২১ ফেব্রুয়ারী 'আজ আর শুধু আমাদের নয়--সমগ্র বিশ্বের 'ভাষা দিবস' রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে।এ আমাদের অনেক বড় গৌরব---অনেক বড় অহংকার । কিন্তু আমাদের এই গৌরবকে বিশ্ব-দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত-মহীয়ানরূপে দেখতে চাইলে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।আন্তর্জাতিক অঙ্গনে 'বাংলাদেশ ' নামক দেশটিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।যে দেশের ছেলেরা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে ইতস্তত করেনি--স্বাধীনতার জন্য বুলেটের সামনে নির্দ্বিধায় বুক পেতে দিয়েছিল ----সে দেশ দেশদ্রোহী-স্বাধীনতাবিরোধীদের আবাসভূমি হবে ভাবা যায়না। যে মাটিতে শত শহীদের পবিত্র রক্তস্রোত বয়ে গেছে সে মাটিতে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াবে স্বাধীনতাবিরোধীরা এই নির্মম পরিহাস কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না।আবার কিছু লালসা-গ্রস্ত মানুষের দুর্নীতিগুলো যা এদেশের উন্নয়নের প্রতিবন্ধক তাদের এই কর্মকান্ডগুলোকেও মেনে নেওয়া যায়না।এসব অগৌরবের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করে তার হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হবে আমাদের সবাইকে মিলেমিশে---দলমত নির্বিশেষে।পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারিত হোক ---'দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী-স্বাধীনতাবিরোধী'--এভাবে।শুধুমাত্র দল বিভাজন করে অনৈক্য সৃষ্টি করে রাখলে বিশ্বাসঘাতক অপশক্তিগুলোই বারবার জয়ী হবে।
নিজের প্রাণের থেকেও দেশ বড় সে প্রমাণ রেখে গেছে আমাদের শহীদেরা ।তাহলে তাদের উত্তরসূরীরা কেন দেশকে দলের উর্ধ্বে স্থান দিতে পারবেনা?কারো পছন্দের দল ক্ষমতায় যেতে না পারলে সেকি সরকারী দলের সমস্ত ভাল কাজগুলোকেও বিরূপ দৃষ্টিতে দেখবে,বিরূপ সমালোচনা করবে --যাচাই-বাছাই ছাড়াই? আর যার পছন্দের দল ক্ষমতাসীন তারা সরকারের অন্যায় কাজগুলোও চুপ থেকে হজম করে যাবে নিজের মনোনীত দল বলে?এই মানসিকতা বলতে দ্বিধা নেই আমাদের অধিকাংশের মাঝেই আছে । এবং এটা হলো আত্মঘাতী-মানসিকতা। আমাদের সমস্ত পশ্চাৎপদতার মূল কারণ এটাই।যতদিন পর্যন্ত আমরা এই দলাদলিকে দেশের উন্নয়নের থেকেও বেশী প্রাধান্য দেবো ততদিন পর্যন্ত দেশ যে অন্ধকার-গহ্বরে পড়ে আছে সেখানেই পড়ে থাকবে। কারণ জনগণই শক্তি। জন-প্রতিরোধের মুখে কোন অন্যায় যেমন প্রশ্রয় পেতে পারেনা তেমনি জনগণের সহায়তা ছাড়া কোন উন্নয়ন তৎপরতার সাফল্যের সম্ভাবনাও কমে যায়।জনমতের অনেক বড় ভূমিকা আছে রাষ্ট্র পরিচালনায়,রাষ্ট্রের উন্নয়নে।

ভাষা আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক মাসটিতে আমাদের সকলের শপথ হোক দেশ গড়ার ।স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে নির্মূল করার।দেশকে স্থান দিন সবার উপরে। দল নয় ----দেশকে ভালবাসুন। ভাষা আন্দোলনের এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এটাই আমাদের একমাত্র এবং শ্রেষ্ট উপায়।


প্রবল-প্রতাপ শাসক



ক্রমাগত বদলে যায় দিনযাপনের রংগুলো
এখনো এই শেষ বিকেলের বারান্দার গ্রীলে
এক ফোঁটা কমলা-রোদ্দুরের গন্ধ লেগে আছে।

নিত্যকার রৌদ্র-দগ্ধ নগরীতে আনাগোনা
হাতের তেলোতে এক মুঠো রোদ মেখে নিলে
'পাপ','পাপ' ---চারপাশে ভৎর্সনার শব্দ ওঠে
এই সব নিত্য-রোদ-রং পাপ?
সবাই নগরপিতা?

সেই সব স্খলনের কি নাম তবে
ছায়ার আড়ালে ঢেকে রাখা কুকুরবিলাসগুলো?
পঙ্কে ডোবানো পাগুলো সাতবার জলে ধুয়ে নিলেই
শুচিস্মিত-পুণ্যাত্মা?

তোমার অসীম-করুণানিদান এক প্রভু আছেন জানি।
ধন্য তুমি। তোমার প্রভুকেও ধন্যবাদ।

মাথার উপরে শাণিত-কৃপাণ কখনো খাপবদ্ধ নয়;
আমার প্রবল-প্রতাপ শাসকের কথা তোমার জানা নেই।

আমার ভয়গুলো



ছেলেবেলা খাকী পোষাক দেখলে খুব ভয় পেতাম।মানে--পুলিশ।পুলিশ আমার সামনে কোন অপকর্ম করেছে বলে আমার ছেলেবেলার কোন স্মৃতি নেই অবশ্য।তবু যে কেন পুলিশের নাম শুনলেই একটা ভয় তাড়া করতো। আর শোনার চেয়ে বেশী-খাকী পোষাকটাই ছিল রূপকথার গল্পে শোনা -দানো-রাক্ষসের প্রতিমূর্ত্তি। এত ছেলেবেলায় কোন তফাৎ করা সম্ভব ছিলোনা তাই যে কোন দফতরের পিয়ন-আর্দালী(ওদের জন্যও ওই খাকী রংটাই প্রচলিত ছিল তখন) দেখলেও ভাবতাম পুলিশ।ভয়ের চোটে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলার কোন কলা-কৌশল, মন্ত্র-টন্ত্র জানা আছে কিনা মনে মনে হাতড়ে বেড়াতাম।
আমার কৈশোরের স্মৃতি হলো একাত্তর।পাকিস্থানী সেনার চক্রা -বক্রা পোষাক আর মিলিশিয়ার(আধা সামরিক) কালো পোষাক এমন প্রভাব ফেলেছিল --সেই কিশোর মনে যা থেকে আজ পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পারিনি।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বারবারই ঘটে।সেই ভয়টাই বারবার ফিরে ফিরে আসে।
এতো গেল পোষাক ভীতির কথা।
আরেক ধরনের মানুষ আমার ভীতির তালিকার প্রথম সারিতে আছে----তারা হলো দালাল। ছেলেবেলা জমির দালাল, বীমার দালাল,গরু-ছাগল ইত্যাদি ইত্যাদির দালালের সাথে পরিচিত ছিলাম।তারা হল নিরাপদ দালাল।
ভীতিকর দালাল দেখার শুরুও সেই একাত্তর থেকেই।স্বাধীনতা বিরোধী দালালদের বর্বর নৃশংসতার,বিশ্বাসঘাতকতার এবং চরম নোংরামীর ছবি দেখলাম সেই সময়েই।নিজের দেশের সাথে--দেশের মানুষের সাথে--নিজের পাড়া-প্রতিবেশী-স্বজনের সাথে সেই বিশ্বাসঘাতকতার দলিল আজো বিশ্বব্যাপী দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
সেই থেকেই' দালাল'( ব্যবসা- বাণিজ্যের ব্রোকারদের প্রসংগ এখানে আসছেনা) শব্দটির প্রতিও এক তীব্র ঘৃণাবোধ কাজ করে।
আমার ভয় এবং ঘৃণার পাত্র হলো যে কোন অপশক্তির দালাল।
বিভ্রান্তিকর ব্যাপার হলো দালালদের কোন নির্দিষ্ট পোষাক নেই।দেখে চেনার মতো কোন চিহ্ন শরীরে ধারণ করেনা। ওরা সাধারণ পোষাকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভীড়ে মিশে থাকে।আর পৌরাণিক কাহিনীর 'ঘরের শত্রু বিভীষণের'মতো অনবরত নিজের ঘরের দেয়ালে ছিদ্র করে যায়।চোরের মতো সিঁদ কেটে কেটে দেয়ালের ভিত দুর্বল করে দেয়একটু একটু করে।
দেশের শত্রুই ছদ্মবেশী দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।প্রয়োজনএদের প্রতিরোধ করার। নাহলে এই হাজার সমস্যা পীড়িত-ঘুণপোকা ধরা দেশটি ক্ষয় হতে হতে একসময় ধুলায় মিশে যাবে।
আমি ভীতু মানুষ। আমার মতো ভীতু মানুষ আরো অনেক আছে। কিন্তু ভীতু হলেও আমি সবসময় আশাবাদী।সারাক্ষণ খুব প্রত্যাশা নিয়ে থাকি একদিন সাহসী মানুষের সম্মিলিত হাতগুলো বলীয়ান হয়ে উঠবে। এবং আমার মতো ভীতু মানুষের ভয়ের কারণগুলো চিহ্নিত এবং নির্মূল করতে সক্ষম হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন