শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৪

বলি ও আমার গোলাপবালা

যে নগরীর উত্থান-পতনের সাথে স্পন্দিত হয় ষোল কোটির হৃৎস্পন্দন----সেই নগরীর নাম ঢাকা।রাজধানী। বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র।শিল্পকলা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির সূতিকাগার।ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের  'প্রাণ-ভ্রমরা'র কৌটা ' এই ঢাকায়।ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের চলেনা।ঢাকা আমাদের প্রয়োজন। ঢাকা আমাদের ভালবাসা।
      শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা, উচ্চতর শিক্ষা-দীক্ষা,আর্থ-রাজনৈতিক চর্চা,উন্নততর চিকিৎসা সুবিধা এমনকি বিদেশ ভ্রমণের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ারও কেন্দ্রবিন্দু এখানেই।এজন্যই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লক্ষ মানুষ প্রতিদিন এখানে ছুটে আসছে।কেউ প্রয়োজন শেষে ফিরে যাচ্ছে, কেউবা এখানেই খুঁজে নিচ্ছে একটি স্থায়ী ঠিকানা।মানুষ আসছেই।
      সত্তর দশকের ঢাকার সাথে আজকের ঢাকার আকাশ-পাতাল ব্যবধান আমার নিজের চোখেই দেখা।শতাব্দী-প্রাচীন এই নগরী যত আয়তনে বেড়েছে, বাড়ছে ততই বাড়ছে বাড়তি মানুষের চাপ।বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে যতই নাভিশ্বাস উঠুক ঢাকাকে এই বাড়তি চাপটুকু সহ্য করে যেতেই হবে। উপায় নেই।


বনানী থেকে বসুন্ধরা যাচ্ছি কামাল আতাতুর্ক সড়ক দিয়ে।গুলশান গোলচক্করের ঠিক আগে আগে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছি।মোড়ের ডিজিটাল বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দেখছি। ' একটু খানি লাক্সের ' নেকু নেকু টাইপ বিজ্ঞাপন দেখে হাসি পাচ্ছে।এমন কড়া মেকআপ আর গা ভর্তি গয়নার জাঁকজমকের ভিতরে  'একটু খানি লাক্সের ' অবদান বা মাহাত্ব্যটা ঠিক কোথায় খুঁজে পাচ্ছিনা।
গাড়ীর গ্লাসে ঠোকা।মুখ ফিরিয়ে দেখি জানালা জুড়ে বিরাট একতোড়া লালগোলাপ; শালপাতায় জড়ানো।হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড়জোর দশ কি এগারোর এক কিশোরী। মায়াকাড়া চেহারা। ডাগর চোখ।নাহ! অদূর ভবিষ্যতেও এই মেয়েকে নিয়ে কারো , " বলি ও আমার গোলাপবালা..........................." , গানটি   গাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।সেই পেডিগ্রিতে মেয়েটির জন্ম হয়নি।গানেরও শ্রেনীভেদ আছে।
ফুল ভালবেসে নয়, নিতান্তই পেটের দায়ে ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ব্যস্ত নগরীর এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়ানো।এই শিশু বয়সেই নামতে হয়েছে কঠিন জীবন-সংগ্রামের পথে।পদে পদে কত বিড়ম্বনা; ভয়। চারদিকে কত প্রলোভনের ফাঁদ।এই সমাজেরই  বিরাট একটা অংশ জুড়ে আছে কিছু কুৎসিত, নোংরা মানুষের কালোহাত।
সুযোগ পেলে এই ফুলের মতো পেলব-কোমল শিশুটিকেও রেহাই দেবেনা তাদের লোভের থাবা থেকে।এই ঝলমলে  নগরীর তিলোত্তমা রূপের আড়ালে যে তমসাচ্ছন্ন আরেক রূপ ,মেয়েটি হয়ত এর মাঝেই তার কিছুটা আভাস পেয়ে গেছে।
মানসচক্ষে দেখছি উঠোনের একপাশে খড়ের গাদা,পুঁইমাচা; শনে-ছাওয়া ছোট্ট কুটির; নিকানো দাওয়া।মাথার উপরে অবারিত নীল আকাশ নিয়ে হলুদ শর্ষের ক্ষেতে প্রজাপতির পিছনে পিছনে ঝম ঝমা ঝম নুপুর বাজিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে দুইটা কিশোরী পা।হায়রে জীবন! যে যেখানে মানানসই সে যদি সেখানেই থাকতে পারতো!

এই নগরীর এমন কোন রাস্তা পাওয়া যাবেনা, যেখানে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত শিশু-ফেরিওলাদের দেখা পাওয়া যায়না।ফুল,চকোলেট,পপকর্ন,জলের বোতল,ন্যাপকিন, টাওয়েল, মসলা মাখা আমড়া, শিশুপাঠ্য বই,খেলনা,সেপটিপিন,চুলের কাঁটা,রিবন;এসব রাজ্যের রকমারী জিনিষপত্র নিয়ে রাজধানীর পথে পথে ফেরী করে বেড়ায় কচি কচি শিশুর দল।আরেক দল আছে যারা  একটা ছেঁড়া-খোড়া বস্তা কাঁধে নিয়ে সারাদিন এগলি-ওগলির ডাস্টবিন ঘেঁটে ঘেঁটে  সচ্ছল মানুষের উচ্ছিষ্ট কুড়ানোতে  ব্যস্ত।ওদের যেন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি বলে কিছু নেই।শহরের সব ব্যস্ত রাস্তাই ওদের বানিজ্য-কেন্দ্র। আশ্রয়ও বটে।কারো কারো দেড়হাতি  বস্তি-ঘরের সামান্য একটা আবাস আছে, কারো বা তাও নেই।সড়কের একপাশে কোন ফুটপাথে কোনমতে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া।
ওরা এই তিলোত্তমা নগরীর রিফিউজি; অনাকাঙ্খিত-অবাঞ্চিত।নদীর ভাঙ্গন,অসময়ের খরা ইত্যাদি নানা প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের শিকার হয়ে নিজের গ্রাম-ঘরবাড়ী ছেড়ে একটু নিরাপদ আশ্রয়, এক মুঠো ক্ষুধার অন্নের আশায় পরিবার-পরিজনের হাত ধরে একদিন পাড়ি দিয়েছে এই অচেনা নগরীর নাগরিক জীবনের অংশীদার হতে।  
 মাত্র দশটি টাকায় তিন তিনটা গোলাপ দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে  এ গাড়ী থেকে ও গাড়ীর জানালায় জানালায় ছুটে যাচ্ছে একটি কিশোরী করুন মিনতি ভরা অনুনয় নিয়ে ।কেউ ফিরেও তাকাচ্ছেনা।কেউবা মহা বিরক্ত হয়ে ধমক দিচ্ছে, গাড়ীর পাশ থেকে সরে যাবার জন্য।
হয়ত অনতিদূরের ফাইভ স্টার ওয়েস্টিনের লাউঞ্জে এই মুহূর্তেই  হাজার টাকার  সুস্বাদু কেক-পেস্ট্রি ,মিলশেইক বা ফ্রুটজুস চাখছে  ওরই বয়সী প্রজাপতির মতো রঙ্গীন কিশোর-কিশোরীরা।
সামাজিক এই বৈষম্যের কথা ভাবলে মাঝে মাঝেই খুব মন খারাপ হয়ে যায়।বিত্ত না থাকুক পেট ভরে দু'বেলা ভাত খাবার সামর্থ্যটুকু অন্ততঃ থাকার দরকার ছিল।
এই সব মন খারাপও দীর্ঘায়িত হয়না।জীবন-যাপনের কঠোর বাস্তবতা আমাদের মাঝে এক ধরনের নির্লিপ্তি এনে দিয়েছে।চোখগুলোও আস্তে আস্তে হয়ে যাচ্ছে অনুভূতিহীন ; অনেককিছু দেখেও দেখিনা।

বাসায় ফিরি। দৈনন্দিন জীবনচক্রে ফিরে আসা।রুটিন কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া,টিভি দেখা। সেন্টমার্টিনে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো, কোরিয়ান ফেরিডুবিতে হারিয়ে যাওয়া কিশোর-কিশোরীর দুঃখে ভারাক্রান্ত হতে হতে ভুলে যাই খানিক আগে দেখা গোলাপবালার কথা।জীবনতো এমনই!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন