রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ঘর

এক জীবনে এই সত্য বারবার জেনেছি
প্রবল ঘরের নেশাই মানুষকে ঘরছাড়া করে।


শেষবেলা
মোমের ফোঁটার মতো ঝরেছিল চোখ
চৌকাঠে আজো তার দাগ পড়ে আছে।

কোন না কোন বিকেল জুড়ে ঘর-বারান্দাময় প্রখর কৃষ্ণচুড়ার ঘোর ;অন্ধকারের তর্জনী ভেদ করা দুর্দান্ত চাঁদনী এবং স্বপ্নের ঝালরে মোড়া অলৌকিক কোন রাত।
যে জীবনে স্বপ্নগুলো ঘাসফড়িংয়ের মতো পেলবমোহনসবুজ ছিল ;ছিল কুয়াশার সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে ফুটে ওঠা স্নিগ্ধ রোদের মতো; সেইসব সুদূরের স্পর্শাতীত দৃশ্যকল্প
ফ্রেমবন্ধী ছবি-ইতিহাস।মায়ার কাজল মুছে গেলে পৃথিবীর ভিন্ন রং ,ভিন্ন রূপ-রস।স্মৃতির কবরে ঢাকা আনন্দের আয়ু।

বাড়ীটা তেমনি আছে। জানালার শার্সির ফাঁকে ঢুকে পড়া শিশুস্কুলের সমস্ত  কলরব-খুনসুটি; শৈশব-শৈশব নস্টালজিয়ার বিকেল-দুপুর ; ঝুলবারান্দায় চড়ুইয়ের হুটোপাটি, আলস্যে  গড়িয়ে পড়া এক খন্ড রোদ।
সব অবিকল।


শুধু আমিই আর এই বাড়িতে থাকিনা।

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

অনিদ্রার রাতে বর্ষণ-প্রত্যাশা

 




 ' আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায় '

কাকে মনে পড়ে? কে সে?সে কি শরীরি কেউ? নাকি স্মৃতি-মেদুরতায় আচ্ছন্ন আজন্ম-বিস্তৃত এক অলৌকিক অস্তিত্ব?মনে পড়ে। কত কি যে মনে পড়ে!
বৃষ্টি মানেই স্মৃতির হাত ধরে পিছনে হেঁটে যাওয়া।বৃষ্টি মানেই মনের ভিতরে গুনগুনিয়ে উঠা 'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল"।ব্যালকনির রেলিংয়ের বাইরে হাত বাড়িয়ে  অবিরল জলধারাকে ধরতে যাই ।হাত ভিজে যায়।এই ভেজা করতলের কোমল-শীতলতায় একাকার হয়ে যায় সমস্ত শৈশব-কৈশোর, অতীত-বর্তমান।


মনে পড়ে সেই দুরন্ত শৈশব।
বৃষ্টির জল জমে ঘরের সামনের উঠোনটা যেন এক ঢেউ-খেলা নদী।সে নদীতে ভাসছে ছোট ছোট কাগজের নৌকাগুলো।যেন শ্বেত-শুভ্র জুঁই গুচ্ছ ভেসে চলেছে কোন এক স্বপ্নের দেশে।যেন রাজপুত্রের সপ্ত-ডিঙ্গা চলেছে বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্য পাতালপুরীর অজানা দেশে।কেমন সে রাজকন্যা?' কুঁচবরণ কন্যারে তার মেঘবরণ কেশ '...............।কুঁচবরণ? সে আবার কি? আর মেঘবরণটাই বা কি?ছোট্ট মনে কত যে প্রশ্নের আঁকিবুকি।বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে।কিন্তু এই পর্যন্তই ।বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করার কথা ঠিক সময়ে আর কখনো মনেই পড়তনা।রহস্যময়ী সেই রাজকন্যা সমস্ত শৈশব জুড়ে অজানা-অচেনা-রহস্যময়ী হয়েই রইল।আর রইল 'ঝ র ঝর মুখর ভাদর দিনে' কাগজের নাও ভাসানোর খেলা।সব আয়োজন এক বীরবাহাদুর রাজপুত্রের জন্য----সপ্ত-ডিঙ্গা সাজিয়ে যে যাবে রাজকন্যার দেশে ।দৈত্য-দানোর পাহারা এড়িয়ে সোনার কাঠি-রুপার কাঠি বদলে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে,উদ্ধার করে নিয়ে আসবে সেই চির-রহস্যময়ীকে।তারপর?সেই শৈশব-ভাবনায় তার আর কোন পর ছিলনা।অর্থাৎ একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের খসড়া।
শিলাবৃষ্টি হলে কী যে  আনন্দ!শিল কুড়িয়ে বোতলে জমা করে রাখা। ক'দিন পরে হয়ত মনে পড়ল সেই শিল জমানো বোতলের কথা।ও মা কোথায় কি!এ যে কেবল জল ভরা একটি বোতল!মনের কোনে এমন সন্দেহও উঁকিঝুঁকি দেয় কেউ হয়ত ওই সুন্দর সাদা বরফ খন্ডগুলো চুরি করে তার বদলে বোতলে জল ভর্তি করে রেখে গিয়েছে।কিন্তু আসামীকে কিছুতেই সনাক্ত করা যাচ্ছেনা যে!
এভাবেই আশৈশব জল-হাওয়ার ভিতরেই বেড়ে উঠা । বসবাস।খরাপীড়িত দিনগুলোতে এক পশলা বৃষ্টির জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়।হাঁসফাঁস করি।
ঋতু আসে।ঋতু যায়।কিন্তু বর্ষা না এলে যেন প্রকৃতি এবং মন কোনটারই যেন পূর্ণতা আসেনা।কখনো রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটে যায়।শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরার আরামদায়ক ঠান্ডা আমেজও এক টুকরো ঘুমকে নিশ্চিত করতে পারেনা। এইসব অনিদ্রার রাতগুলোতে ঘোর বর্ষার একটানা বৃষ্টির  রিমঝিম শব্দের জন্য ছটফট করি।ছেলেবেলার টিনের চালে ঝমাঝম মাদল-করতালের ছন্দে বাজা বৃষ্টির শব্দ শুনে শুনে ভীষণ প্রশান্তির ঘুমের কথা ভেবে তীব্র নস্টালজিক হই।
এসো বর্ষা।
এসো বৃষ্টি ।
এসো ঘুম।

ঘুম অথবা ঘুমহীনতায়

কষ্টগুলো সোনালী র‍্যাপিংপেপারে মুড়ে রাখি সুস্বাদু চকোলেটের মতো।

রাত পুড়ছে জোনাকধরা হাতের মুঠোয় ।ঘরময় এই শীতলতা----- এক  পশলা বৃষ্টির পরে।
দীর্ঘশ্বাসের দাগগুলো ধারাজলে মুছে গেলে চারপাশ ঘিরে থাকে নিঃসীম স্থবিরতা।স্থবিরতা?
নাকি মুমূর্ষার গন্ধ ভেসে আসে মাঝরাতের বেহালার মতো ক্লান্ত; বিধ্বস্ত !



নীলঅন্ধকারের বুক জুড়ে 'কুব', 'কুব' করে খুব ডেকে যায় নাম না জানা রাতজাগা পাখী।কে জানে কি যে ব্যাথার বৃষ্টি ঝরে তার পাখসাটে!স্রোতে ভেসে যায় তার কয়টা পালক

কি আশ্চর্য সমাসঙ্গ  পাখী ও মানুষের!যেখানেসেখানে অগোচরে মায়ার পালক ছড়ানো

ধু-ধু তেপান্তরের মাঠে টগবগটগবগ সাদা ঘোড়া
পালিয়ে যাচ্ছে রূপকথার গল্প-কাহিনী।আর কোন ঠাকুরমার ঝুলি নেই।জিয়ন-কাঠি?নেই।

জীবন গুটিয়ে আছে কেন্নোর মতো; কুন্ঠিত।ম্রিয়মাণ।

কেন যে আধোঘুমের ভেতরে আচমকা ফালিজ্যোৎস্নার মতো এক চিলতে স্বপ্ন ঢুকে পড়ে

নদী

আঙ্গুল পুড়েছে।বালিকা ছুঁয়েছে স্রোতের আগুন।



নদী কি অনায়াসে ধরে রাখে আগুন প্রতিবিম্ব এবং শামুক।দীর্ণ হচ্ছে
শীর্ণ হচ্ছে
ক্রমাগত শামুকের খোলে গুটিয়ে যাচ্ছে অন্তহীন জীবন।

লহরের ছন্দে ছন্দে গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসে রূপালি শরীরের মাছগুলো।
হায় বোকা মাছ!ধরা দিলে নিকিরির লোভী জালে
পানকৌড়ির নিষ্ঠুর ঠোঁটে?


কতবার ভাবি এইসব ক্ষুদ্র জীবনের শোকগাঁথা লিখে যাবো
লিখে যাবো---উম্মাদ স্রোতের টানে নৌকা টেনে নেওয়া প্রমত্ত-নদীর নির্মমতার কথা

কী যে রহস্য নদীর
তরঙ্গ নিজেকেই অবিরত ভাঙ্গছে ঢেউয়ের ভেতরে!


একবার পিছু ফেরো নদী
দেখো
চরের বালিতে ফেলে যাচ্ছো লাল নাকফুল চুলের রিবন

ভাসানের পদ্ম-পাপড়ি পূজোর নৈবেদ্য।

অনিদ্রা

রেডিয়ামে জ্বলে মধ্যরাত।         
না ঘুম । না স্বপ্ন ।

অন্ধকারের ডানায় লুকোনো পক্ষীরাজ
ঘোড়া।দেয়ালে নিকষ-আঁধার ছায়া কেঁপে কেঁপে উঠে।
কালো চাদরের নীচে জেগে থাকে ভয়।
রাত জাগা পাখী তার বিষন্ন ঠোঁটে ছুঁয়ে গেছে ঘুমের পেয়ালা।
জানালার ফ্রেমে এক খন্ড বিনিদ্র-আকাশ;
তারাগুলো পুড়ছে অনিদ্রার আগুনে রাতভর।

জেগে থাকে শিউলির বন।তীব্র-নীল সুরের বেহালা বাজে অস্ফুট-ব্যথার হাহাকারে
সারারাত নীহারের অশ্রুকণা ঝরে ঝরে পড়ে।
দূর-গাঁয়ে মাতাল মাদল বাজে।খোঁপায় কুরচির ফুল গোঁজা রমনীরা ঘুমায় সোহাগে;
স্বপ্নের ভিতরে মহুয়ার বন---মাদলের টান।

শহরে কোথাওনা কোথাও ঠিক জাগে পানশালা।
শ্যাম্পেনের বুদবুদে-উদ্দাম রকে শান্তির ঠিকানা খুঁজে ঘুমহীন মানুষেরা।


চুমুকে চুমুকে তরল-গরল।
চুমুকে চুমুকে মৃত্যুপান।